Saturday, 9 December 2017

মূল্যায়ন

কবিগান পল্লী অঞ্চলের বিনোদনের যেমন মাধ্যম তেমনি শিক্ষা বিস্তারেরও মাধ্যম। বর্তমান সময় সরকার কবিগানকে শ্রেষ্ঠ মিডিয়া বলেছেন। সরকারী পরিকল্পনা রুপায়নে কবিগানকে গনমাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এই ইলেট্রনিক যুগেও তা অব্যাহত। আমাদের এই দুর্ভাগা দেশের পল্লী অঞ্চলের দুর্গম প্রান্তের প্রায় নিরক্ষর মানুষের কাছে নীতিশিক্ষা,সমাজশিক্ষা,প্রভৃতির আলোকবর্তিতা বয়ে নিয়ে যেতেন এই সকল কবি সরকারেরা। নীতি-শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ গঠনে তারা সহায়ক হয়েছেন। মানব মনের যে অনন্ত জিজ্ঞাসা যেমন ধর্মজিজ্ঞাসা,আত্মজিজ্ঞাসা সন্ধানের প্রচেষ্টা করা হয়েছে কবিগানে। এই ধর্ম আলোচনায় দুটি পৃথক দৃষ্টিকোণের অবস্থান থাকতে দেখা য়ায়। একজন কবি কঠিন বাস্তবকে তুলে ধরে মানবীয় কামনা বাসনা প্রভৃতির আলোকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা তুলে ধরে থাকেন। অপর কবি ধর্মের অন্তরদর্শন ব্যাখ্যা করতে থাকেন। বলা চলে বস্তুগত যুক্তিবাদ বনাম ভাববাদ, আত্মবাদ, আধ্যাত্মবাদের সংঘর্ষ হয়। তবুও কবিগানে শুধুমাত্র ধর্মীয় সংগীত নয় এরমধ্যে জড়িয়ে রয়েছে ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি।
কবিগানের উপকারিতা অনুধাবন করতে গিয়ে উপলব্ধি করা য়ায় যে পরিমানের উন্নয়ন পুর্ববঙ্গের কবিগানের মধ্যে দিয়ে লক্ষ্য করা য়ায় তা পশ্চিমবঙ্গের কবিগানে লক্ষ্য করা য়ায় না, এখানে কবিগানকে মূলত মধ্যকোলকাতার বিলাসী বাবু কালচারের মনোরঞ্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
কবিগান সম্বন্ধে সমালোচনা করতে গেলে দুটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমত বর্তমানের নিরিখে এর মূল্যায়ন করলে তা যথার্থ হবে যা মোটেই কাম্য নয়। একে দেখতে হবে বাংলা সাহিত্য ইতিহাসের একটি বিশাল ইমারতের ইট হিসেবে।দ্বিতীয়ত,চাই নিরাসক্ত দৃষ্টি। এখানে প্রাদেশিকতা ও জাতিতত্ত্ব বিসর্জন দিতে হবে। এ না হলে সমালোচনা হবে পক্ষপাত দোষ দুষ্ট। একাধিক ক্ষেত্রে যা দেখা গিয়েছে। অতএব নিরাসক্ত সমালোচনা একান্ত কাম্য।

বিভিন্ন পর্বের কবিয়াল পরিচিতি

গোঁজলা গুঁই :- কবিগানের আদিপর্বের গুরু হিসেবে বিখ্যাত। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত গোঁজলা গুঁই এরগানের মাধ্যমে কবিগানের সুচনার কথা বলেছেন। তিনি সে সময়ে পেশাদার দল গঠন করেন এবং বিভিন্ন সম্ভান্তশীল পরিবারে অর্থের বিনিময় তিনি গান করতেন। যেহেতু আদি পর্বে কবিয়ালরা মূলত নিন্ম বর্গীয় শ্রেণীরা মুক্ত ছিল এবং সেইসব মূল্যবান কাব্যসামগ্রী সংরক্ষণের কোন চেষ্টা ও উপযোগীতা উপলব্ধি করা হয়নি। ফলত সেই সমস্ত কাব্য ও কবিয়ালদের সম্বন্ধে তথ্যের পরিমান অতীব স্বল্প ও সীমাবদ্ধ।

রাম বসু :- দ্বিতীয় পর্বের অন্যতম করিয়াল। রামমোহন বসু অল্প বয়সেই কবিগান রচনা শুরু করেন তিনি ছিলেন আধুনিক জীবনধারার ছোঁয়া। মানবমুখী বাস্তবতা তাঁর গানের বৈশিষ্ট্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের 'তিন সঙ্গী' গ্রল্পগ্রন্থে হরি ঠাকুর ও রাম বসুর নামের উল্লেখ পাওয়া য়ায়। তাঁর একটি বিখ্যাত গান হল -
মনে রৈল সই মনের বেদনা।
প্রবাস যখন য়ায়গো সে,
তারে বলি, বলি বলা হলনা।
শরমে শরমে কথা কওয়া গেলনা।
যদি নারী হয়ে সাধিতাম তাকে নিলজ্জা রমনী বলে হাসিত লোকে।
                      সখি, ধিক্ থাক আমারে, ধিক সে বিধা তারে, নারী জনম যেন করে না।

অ্যান্টিনি ফিরিঙ্গী :- প্রথম ইউরোপীয় বাংলা ভাষার কবিয়াল। তৃতীয় পর্বের কবিয়ালদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি ছিলেন একজন পর্তুগিজ, উনবিংশ শতকে বাংলাতে চলে আসেন প্রথমে যে পশ্চিমবঙ্গের ফরাসডাঙ্গা নামক এলাকার বসতি স্থাপন করেন। লোককবিদের মুখ থেকে কবিগান শুনে তিনি প্রবল অনুপ্রাণিত হয় এবং গান বাঁধতে শুরু করেন। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্নের উর্ধ্বে গিয়ে তার গানের মাধ্যমে মানুষ ও মানবতার সুর ফুটে ওঠে। তার অন্যতম জনপ্রিয় গানটি হল -'সাধনভজন জানিনে না, জেতে তো ফিরিঙ্গি। 'তিনি এক ব্রাহ্মণ হিন্দু মহিলাকে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে উদ্ধার করে, পরে তাকে বিবাহ করেন। তাঁর গান গুলির মধ্যে গ্রামবাংলার চিরাচরিত কুসংস্কার গুলির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে দেওয়ার রসদ ছিল তাঁর গানগুলির মধ্যে। তার অন্যতম প্রতিপক্ষ ছিল ভোলা ময়রা। তিনি দক্ষিণ কোলকাতা একটি কালি মন্দির স্থাপন করেন তা ফিরিঙ্গী কালিবাড়ি নামে খ্যাত। অ্যান্টিনি ফিরিঙ্গীকে নিয়ে বিখ্যাত দুটি বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত 'অ্যান্টিনি ফিরিঙ্গি' ও 'জাতিস্মর'।
উৎস -বাংলা সিনেমা যাতিস্বর(এন্টোনি  ফিরিঙ্গীর চরিত্রে প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জী
ওয়েবসাইট -www.news24.com

Thursday, 7 December 2017

নারীশক্তি বিকাসে কবিগানের প্রভাব

পৃথিবীর সর্বত্র পুরুষ শাষিত সমাজে ব্যবস্থায় নারীর কোন অধিকার স্বীকৃত ছিল না। মৌলবাদী রক্ষনশীল গোষ্ঠীর যৌথ চক্রান্তে নারী সমাজ সামাজিক -রাজনৈতিক -ধর্মীয় -শিক্ষা প্রভৃতি সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছে বহু যুগ ধরে ।পৃথিবীর বিভিন্ন সময় মনীষীরা নারীশক্তি জাগরনের চেষ্ঠা করেছিলেন এবং কম-বেশী সফল হয়েছেন।
নারীমুক্তির জন্য লোককবিদের একটি বিশেষ ভূমিকা গ্রহন করেছিলেন ।কৌটিল্য প্রথা, পনপ্রথা এবং বিধবাবিবাহ -এই ধরনের সামাজিক সমস্যাবলী নিয়ে কবিগন জনসাধারণকে সচেতন করে সমাজ প্রগতির পথ দেখিয়েছেন ।কবি হরি আচার্যের বিধবা বিবাহের একটি গানে আছে -'ভারতে বিধবার উপর চিরদিন ভীষন অত্যাচার।.... পুরুষে যাতা করে,... /যদি বিধবার বিবাহ হইতে দূরে হইত দেশের মনস্তাপ, /ঘুচত বিধবার বিলাপ "(পুর্ববঙ্গের কবিগান সংগ্রহ ও পর্যালোচনা) পনপ্রথা নারী সমাজের যুগ যুগান্তের অভিশাপ। সমাজে তাদের যে কোন মান -সন্মান আত্ম-মর্যাদাবোধ আছে তাই স্বীকার করে না পুরুষ শাসিত সমাজ। পন্য বলে বিবেচিত হয় তারা।
বর্তমান সমসাময়িক সমস্যাবলী ও তার প্রতিকার কল্পে, সাধারণ জনগনকে সচেতন রাখতে ও সমাজ অগ্রসরনে লোককবিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। জন্মনিয়ন্ত্রণ, হামের টীকা, গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বানিজ্য, যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির স্বপক্ষে, স্বরোজগার যোজনা, ইন্দিরা আবাস যোজনা, জহর যোজনা, প্রভৃতি বিষয় অবলম্বন করে লোককবিগন আসরে গান পরিবেশন করে জল সাধারণকে সুন্দরভাবে সেই বিষয়ে অবহিত করে থাকেন। তাই বলা হয়- kobi Song is the best media. সবচেয়ে ভালো গনমাধ্যম /এই যে কবি গান। /ইহা সহজ -সরল সুন্দরভাবে /উভয় পক্ষের আদান -প্রদান "(লোককবি সুরেন্দ্রনাথ সরকার)। সামগ্রিক বিচারে বলা য়ায় ধর্মতত্ত্ব ও অধ্যাত্ম দর্শন নিয়ে যেমন লোককবিরা গান রচনা ও পরিবেশনা করেছেন তেমনি সমাজে চীরনিপিড়িত নারীদের সমাজের উর্দ্ধমুখী ধারার মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন তাদের গানের মধ্যে দিয়ে।এর ফলস হিসেবে সমাজের বহুক্ষেত্রে নারী অভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছিল এরং সমাজ সংস্কার ও সমাজ প্রগতির পখে জনমানুষকে চালনা করতে বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করে।

বঙ্গসমাজে কবিগানের প্রভাব ও অগ্রগতি

    কবিয়াল পালা গান করছেন
    উৎস -www.news24.com
  • বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষ দিকে কবিগানের উদ্ভব হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞগন অনুমান করে থাকেন। কবি ঈশ্বরগুপ্ত গোঁজলা গুঁই কবিগানের আদি কবি বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য পন্ডিতগন এ বিষয়ে এক মত হতে পারেন নি। যাই হোক, কবিহানের পর্যালোনার জন্যে কবি ঈশ্বরগুপ্তই প্রধান পথ প্রদর্শন। কবিগান বাংলা সংস্কৃতির একটি বলিষ্ঠ ধারা। আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলা সংস্কৃতির এই বলিষ্ঠ সজীব ধারা নানা পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। কবিগান লোক সাহিত্যের অমুল্য সম্পদ হিসেবে গন্য হয়ে থাকে, কবিগান বাংলা সাহিত্যে যে ঐতিহাসিক ভুমিকা পালন করেছিল তা অনস্বীকার্য। 
  • জনগনের সাহিত্য হয়ে ওঠার সুচনা দেখা গেল কবিগানেই। মধ্য যুগীয় ব্যক্তি সন্তুষ্টির পথ পরিহার করে জনগনের মনের খোরাক যোগান দেওয়ার এই দায়িত্ব পালন করে কবিগানই। আধুনিক সাহিত্যের কাছে সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা তা সর্বপ্রথম কবিগানের মধ্যে দিয়েই পরিলক্ষিত হয়। আমরা জানি কাব্য সাহিত্য সমাজের দর্পণ।শতকরা আশি শতাংশ মানুষ যেখানে পল্লীতে বাস করে তার অর্ধেকের বেশী স্থান যেখানে এখনও দুর্গম। অনাহারে থেকে আমের আঠি,। বাঁশের কোঁড়, লাল পিঁপড়ের ডিম ক্ষিদের জ্বালায় উদরস্থ করে।যে দেশে সারা পৃথিবীর নিরক্ষর মানুষের অর্ধেক সংখ্যক মানুষ বাস।সেই সব অন্ত্যজ মানুষ সংগঠিত করাই কবিগানের উদ্দেশ্য। সাধনতত্ত্ব ব্যক্ত করতে গিয়ে কবিগান সে যুগের সমাজব্যাবস্থা, অর্থনীতি, শ্রেণী বৈষম্য, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, সামাজিক অরাজকতা প্রভৃতির পরিচয় দিয়েছেন। মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে সর্বত্র কম বেশী সামাজিক চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। বংলা ভাষায় অনুমোদিত মহাকাব্য রামায়ন-মহাভারত এছাড়া চন্ডীমঙ্গল, ধর্ম মঙ্গল, এই সমস্ত কাব্যে তৎকালীন সমাজ জীবনের নানা চিত্র চিত্রায়িত হয়েছে। কবিগানে বর্নিত সমাজে এই বাংলার। কবিগানে বর্নিত লোকাচার, সাধন-পদ্ধতি লোকায়ত মানুষের শিল্প সংস্কৃতি, সমাজ, প্রকৃতি সকলই বাংলার, সম-সাময়িক সমাজ প্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপুর্ন। বস্তুত সাহিত্যের মহৎ উদ্দেশ্য শুধু কল্পনা বিলাসী হয়ে অবাস্তব রুপ মাধুর্য ভোগ নয়। সাহিত্য শুধু বাস্তবকে এড়িয়ে কল্পনা বিলাস নয়। সততা রক্ষা অর্থাৎ সত্যভাষন সৎ সাহিত্যের প্রান ।
  • পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ব্যাবস্থায় কবিগান- এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক যে কোলকাতা কেন্দ্রিক কবিগানে সমাজচিত্র তেমন ভাবে ফুটে ওঠেনি। এমন কি কলকাতাতে গড়ে উঠেছে যে শাসক শ্রেণী তাদের শাসন-শোষন, পীড়ন দমন তথা ঐতিহাসিক -রাজনৈতিক -সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত এদের গানে আসেনি। যদি কিছু কখনে এসে থাকে তা অকিঞ্চিৎকর। এই কবিদের উদ্দেশ্যই ছিল কবি গাহনায় রাজা-জমিদার দের চিত্তবিনোদন। তাই অধিকাংশ সময়ই কবিগান পরিবেশিত হতো রাধা-কৃষ্ণের চটুল প্রেম ও লীলা সংক্রান্ত, যার প্রধান উপাদান ছিল আদিরস এবং রাজা জমিদারদের চাটুকারিতা। তাই বলা যেতে পারে পুর্ববঙ্গে কবিগানের মাধ্যমে যে সমাজের এই সংস্কারমুলক ধারা এসেছিল, তা পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেনি।এটি মুলত চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেব ব্যবহৃত হয়।

Wednesday, 6 December 2017

গ্রামীণ নবজাগরনে কবিগানের প্রভাব

 
উনবিংশ শতাব্দীতে কোলকাতা কেন্দ্র করে রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে নবজাগরন ঘটে। এই নবজাগরন ব্রাহ্ম ধর্মান্দোলন ও নিউ হিন্দু মুভমেন্টের যে একটি বিশেষ ভুমিকা ছিল তা অনস্বীকার্য। রামমোহন প্রবর্তিত নবজাগরন ছিল শহরকে ঘিরে এবং সমাজের উঁচু শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ। গ্রামে সেই জোয়ার এসে পৌঁছাতে পারেনি। গ্রামের অন্ত্যজ, অবহেলিত মানুষের জীবনে এই শহরকেন্দ্রিক রেনেসাঁস কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি,তারা যে সংকীর্ণতায় ছিল সেই গন্ডিতেই রয়ে গিয়েছিল। এই ঊনবিংশ শতাব্দীতে পুর্ববঙ্গে অন্ত্যজ সমাজের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুর। তাঁদের প্রচেষ্টায় মতুয়া ধর্মান্দোলনের মাধ্যমে পুর্ববঙ্গের তথা বঙ্গদেশ অন্ত্যজ মানুষের নবজাগরন সৃষ্টি হয়। এই নবজাগরন ছিল সর্বব্যাপী। কলকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরনের মতো এই জাগরনের কোন সীমাবদ্ধতা ছিল না। মতুয়া আন্দোলনের মাধ্যমে অন্ত্যজ মানুষের মধ্যে শিক্ষা প্রসার, সমাজ সংস্কার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চাকরীর আন্দোলন প্রভৃতি সংঘটিত হয়। 
রামমোহন প্রবর্তিত কলকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরনে মাইকেল মধুসূদন, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় প্রমুখ কবি সাহিত্যিক, দার্শনিক যে ভুমিকা পালন করেছিলেন হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত অন্ত্যজ মানুষের জাগরনে সেই একই ভুমিকা পালন করেছিলেন লোককবি ও অন্যান্য কবিবর্গ। কবি রসরাজ তারকচন্দ্র সরকার, হরিহর সরকার, রাজেন্দ্রনাথ সরকার, আচার্য মহানন্দ হালদার,বিচরন পাগল, কবি বিজয় সরকার, প্রমুখ মতুয়া রেনেসাঁসের কবি।ইউরোপের নবজাগরনে পেত্রার্ক, বোকাচিও,বেকন প্রভৃতির অবদান অনস্বীকার্য। মতুয়া নবজাগরনের লোককবিদের অবদান অপরিসীম। এই কবিরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লোকগানের আসরে গান করতেন এবং শ্রোতাদের নতুন আদর্শে দীক্ষিত করতেন। শিক্ষা বিস্তার এবং বিদ্যালয় গঠনে বিশেষ সহযোগিতা করেছেন।এমনও উদাহারন আছে কবিরা গানের আসরেই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি এবং অর্থ সংগ্রহ করেছেন এবং পরের দিনই সকলকে নিয়ে বিদ্যালয় গৃহ নির্মাণ করেছেন এই জাগরনে লোককবিদের অবদানের কথা কবি রাজেন্দ্রচন্দ্র সরকার একটি গানে বলেছেন -"কবিগানের জন্য জাগে ধন্য নমঃশূদ্র সমাজ। " এইভাবে বিভিন্ন সমাজ সংস্কারমূলক গানের মাধ্যমে কবিয়ালরে গামীন অন্ত্যজ সমাজে যে এক পরিবর্তনের ধারা এনে দিয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য।

Saturday, 2 December 2017

কবিগান ও তরজাগান


কবিগান ও তরজাগান-এর মধ্যে সাদৃশ্য সবচেয়ে বেশি থাকলেও কবিগান এবং তরজাগান এক গান নয়। ডঃ সুকুমার সেন বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেন - "উনবিংশ শতাব্দের মধ্যভাগ কবিগান তরজা লড়াই-এ পরিনত হয়েছিল। "ডঃ সেনের এই মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে কবিগানের জন্ম তরজার আগে এবং দুটো ভিন্নরীতির গান। তা নাহলে পরিনত হওয়ার কথা উঠতো না। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় 'বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত' গ্রন্থে তরজাকে কবিগান এবং পাঁচালি গানের সংমিশ্রণে উদ্ভূত লোকরঞ্জনকারী নতুন রীতির গান হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রাচীনত্বের দিক থেকে কবিগান তরজা গানের থেকে এগিয়ে। শ্রীচিত্তরঞ্জনের দেব মহাশয় তাঁর 'বাংলার পল্লিগীতি গ্রন্থে বলেছেন -"তরজার ইতিহাস খুব বেশী দিনের যে তা নয়।' শ' খানেক বছর আগে হাওড়ার শালকিয়া অঞ্চলের মধু ঠাকুর ও তারক পাল নামক দুই ব্যাক্তিই বাংলার প্রথম তরজা গানের প্রচলন করেন। "কিন্তু এই মন্তব্য কতটা যুক্তিযুক্ত তাতে সন্দেহ আছে। কোনও কোনও সাহিত্যের ইতিহাসকার বলেন -মুর্শিদাবাদের হোসেন খাঁ তরজার প্রচলন করেন। কে বা কারা তরজার প্রচলন করেন সে বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা নিশ্চিত যে কবিগান থেকেই তরজার জন্ম। যদিও অন্যান্য গানের রীতিও তরজায় মিশেছে। কবিগান এবং তরজা গানের মধ্যে সাদৃশ্য এবং পার্থক্য দুই-ই বিদ্যমান।কবিগান ও তরদাগানের মধ্যে অনেক মিল দেখা য়ায়। কবিগানের মতো তরজাগানেও দুটি পক্ষ থাকে। দুটো পক্ষেই একটি করে মূল গায়ক থাকে। বাদ্যযন্ত্রের সামান্য ফারাক বর্তমানে পরিলক্ষিত হয়।কবিগানে বর্তমানে ঢোল এবং জুড়ির ব্যবহার দেখা য়ায়। তরজা গানে ঢোল কাঁসির ব্যবহার দেখা য়ায়। তরজা গানে আর একটি অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়। মূল গায়ক সাধারণত পায়ে ঘুঙুর পরে গান করেন। গানের তালে তালে পা নাচিয়ে বাজান। পোশাকের দিক থেকেও সামান্য ফারাক দেখা য়ায়। কবিগানে কবিয়াল যেভাবে পরিপাটি পোশাক পরিধান করে থাকেন তরজা গানে অতটা দেখা য়ায় না। কবিয়ালরা সাদা ধুতি এবং সাদা অথবা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি পরেন। তরজা গানে গায়ক ফতুয়া এবং হাফ হাতা গেঞ্জি পরে তরজা গান করে থাকে। কবিগান ও তরজা গান ভিন্ন হলেও তাদের গায়কী রীতির মধ্যে অনেক অংশে মিল পাওয়া য়ায় বলেই অনেক কবিকে তরজা গান করতেও দেখা য়ায় ।কবিগানের আদিপর্বে প্রখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রাও দক্ষতার সাথে হোসেন মির্জার সাথে অনেক তরজা গান করেছেন।

Friday, 10 November 2017

কবিগানের ইতিহাস

 কবিগান বাঙালির হৃদয়ের সামগ্রী। জনসাধারণের মনোরঞ্জন ও লোকশিক্ষা এগানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। বাংলা লোকায়ত সাহিত্যের এক বিপুল সম্পদ কবিগানের খনিতে রয়েছে। কবিগানের উৎস ও উৎপত্তিকাল নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে।
কবিগানের আদি বীজ কবির কাব্যশক্তি পরীক্ষার মধ্যে থাকলেও আমরা যে কবিগানের প্রচলন দেখি তার সূচনা পর্বের ভূমি হলো শান্তিপুরের  কবিগান। গঙ্গাচরণ বেদান্ত বিদ্যাসাগর ভট্ট্যাচার্য মহাসয় আঁখড়াকেই সংগীত সংগ্রমের কবিগানের আদিরূপ বলে ব্যাখ্যা করেন -"শান্তিপুর ও ফুলিয়া গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় সংগীত সংগ্রামের অভিনয় উৎসাহের সহিত আরাম্ভ হয়ে গেলো "--এইরূপ বহুকাল ধরিয়া কৃষ্ণলীলার অপূর্ব মাধুর্য আস্বাদনের জন্য আঁখরাই পাড়ার সংগীত সংগ্রামে চলতে লাগলো। কালস্রোতে কবিগানের মাধুর্য ,রীতি বিকৃত হতে লাগলো। অর্থের প্রলোভনে কিছু কবিয়ালেরা  ভাষার নিয়ম ও ভাবসম্পদ উলঙ্গন করতে থাকে এবং কবিগান ব্যবসায়িক  স্বার্থে ব্যবহার হতে থাকে। সংগীত সংগ্রাম নাম পালটে হয়ে যায় কবির লড়াই বা তরজার লড়াই।
দেশ কালের সহিত সামঞ্জস্য রেখে কবিগান শান্তিপুর থেকে নতুন বাণিজ্য কেন্দ্র হুগলি -চুঁচুড়ার পথ ধরে কলকাতা নগরে পৌঁছায়। ইংরেজ অনুগ্রহে পুষ্ট ,নববীয়ানার বার্থ অনুকরণ প্রয়াসী যে জনসমাজ তখন সমগ্র দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ,তাদের মধ্যে দিয়ে কবিগানের প্রসার ঘটেছিলো। "মহারাজ বাহাদুর "নবকৃস্নাদেব এই শ্রেণীর অন্যতম আগ্র-প্রথিক। আচার্য দীনেশচন্দ্রে সেন মনে করেন যাত্রা থেকে কবিগানের উৎপত্তি হয়েছে। তার মোতে উড়বে কবিগান যাত্রার অংশ ছিল ,তারপর এই হালকা ধরণের গান যাত্রা থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে 'কবিগান 'নামে পরিচিতি লাভ করে এবং লোকরঞ্জনের একটি বিশেষ রূপ ধারণ করে। ডঃ সুশীলকুমার দে এর প্রতিবাদ করেন। তিনি তিনটি বিরোধী কারণ প্রতিস্থাপিত করেন। প্রথম কারণ ,কবিগান যে যাত্রার অংশ ছিল ,এ ধরণের প্রমান দেবার মতো কোনও নতুন পাওয়া যায়নি। .দ্বিতীয়ত ,কবিগান ও যাত্রার ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা। তৃতীয়ত ,একই সময়ে যখন কবিগান ও যাত্রার অস্তত্ব পাওয়া যাচ্ছে ,তখন এক থেকে অপরের উৎপত্তি হয়েছে ,একথা বলা যুক্তিযুক্ত নয়। ডঃ হরেকৃষ্না মুখোপাধ্যায় মনে করেন পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত ঝুমুর থেকেই কবিগানের উৎপত্তি হয়েছে। সংলাপধর্মী বা প্রশ্নোত্তরমূলক রচনা ,যাতে নৃত্যগীতের প্রচুর ব্যবহার ছিল ,মধ্যযুগে তাকে বলা হতো ঝুমুর। আদিরস ঘটিত ঝুমুর কালক্রমে পরিবর্তিত হতে হতে কবিগান নামে পৃথক আরেকটি লোকনাট্যের রূপ দেয়। ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র পাল মহাশয় মনে করেন ,সপ্তদশ শতাব্দীতে কবিগানের কোনরূপ অস্তিত্ব ছিলনা। এ মন্তব্য কোনোমতেই শরিকের করা যায়না। কবিগানের মতভেদ নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বেও যে কবিগানের চল ছিল তাতে সন্দেহ নেই। ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ খিষ্টাব্দের মধ্যে ঘটেছিলো বলে ডঃ দে অভিমত দিয়েছেন। অধ্যাপক দে কবিগানের যে তিনটি পর্যায় করেছেন তাতেও দেখা যায় প্রথম পর্যায় ১৭৬০ এর পুর্ববর্তী কালকে চিন্তিত করেন। সুকুমার সেনের মতো সুশীলকুমার দে কবিগানের কোনো প্রাচীনতম নিদর্শনের উল্লেখ করেননি এবং এই প্রসঙ্গে জানিয়েছে যে ,উপযুক্ত তথ্যাদির অভাবে প্রাচীনতম কবি সংগীতের প্রসঙ্গে কিছু বলা সম্ভব না।
'It is very difficult in the absence of materials to trace the origin of this peculiar from of literature ...most of the songs which have come down us belong to a date posterior to middle of the 18th century.

কবিগানের পর্ব  -
প্রথম পর্ব ;-অষ্টাদশ শতাব্দীর পুর্ববর্তী যুগ। এসময়ের কবিগান ও কবিয়াল সম্পর্কে  কিছুই জানা ছিল না.অনুমান করা হয় এযুগেও কবিগানের অস্তিত্ব ছিল।
দ্বিতীয় পর্ব ;অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকে মধ্য ভাগ পর্য্যন্ত। গোঁজলা গুই এবং তার তিন শীষের পরিচয় পাওয়া যায়। এদের জীবন সংকান্ত কিছু তথ্য ও কয়েকটি গান পাওয়া গেছে।
তৃতীয় পর্ব ;অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে থেকে ঊনবিশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক। হৰু ঠাকুর ,নিতাই বৈরাগী ও রাম  বসুর এসময়ে শ্রেষ্ঠ কবিয়াল।
চতুর্থ পর্ব :ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। এযুগে বেশ কয়েকজন শক্তিশালী কবিয়াল জন্মেছিলেন। এঁদের মধ্যে ভোলা ময়রা ,এন্টিনি ফিরিঙ্গি অন্যতম ছিলেন।


Thursday, 2 November 2017

কবিগানের রণকৌশল

কবিগানের সাঁজ ও পোশাক : কবিগানকে আরো অলংকৃত করার জন্য কবিয়ালের ধুতি পান্জাবি পড়েন। সাদা ধুতি হলেও পাঞ্জাবি সাদা বা ঘি রঙের পড়তে দেখা যায়। সাদা বা ঘি রঙের উত্তরীয় এর পাতলা  দিকটা তিন ভাঁজ বা চার ভাঁজ করে মেলে দেন অথবা একদিকে বগলের নিচ দিয়া অপর  কাঁধের উপর দিয়া ছড়িয়ে দাও হয়। মঞ্চে কবিয়ালরা খালি পায়ে থাকেন। তবে এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার কবিদের মধ্যে পোশাকের সামান্য তারতম্য আছে ,ধুতি ও পাঞ্জাবির ব্যাপারে এক হলেও ওপর বাংলার কবিয়ালেরা গলায় মাফলার জড়ান ,পায়ে মোজা  পড়েন। মহিলা কবিয়ালের লাল ও সাদা পাড়ের সাদা সুতির কাপড় পড়েন। অনেক সময় কাপড়ের গায়ে ছোট বুটি  থাকে,উত্তরীয় ব্যবহার করতে দেখা যায়। যাঁরা ঢোল বজায় তাঁরা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া পড়েন ,ইদানিং অনেক ঢোলবাদক পাজামা ব্যবহার করছে।

কবিগানের বাদ্যযন্ত্র : একসময়ে কবিগানে বাদ্যযন্ত্র : একসময় কবিগানে বাদ্যযন্ত্র বলতে শুধু ঢোল ,জুড়ি ও কাঁসির ব্যবহার দেখা যেত। ঢোলের সাথে কাঁসির ব্যবহার হতো। এখন কাঁসির ব্যবহার আর নেই। ইদানিং কিছু বাদ্যযন্ত্রের আবির্ভাব হয়েছে। সুরের সাথে আঁড়বাঁশির ব্যাবহারও দেখা যাচ্ছে এবং হারমোনিয়ামের ব্যবহার এখন আবশ্যক হয়ে পড়েছে। বাদ্যযন্তের প্রাচীন ধারা অব্যাহত রেখেই কবিয়ালরা এখনো কবিগান করে চলেছে বিষয়টা সত্যি প্রশংসনীয়।

কবিগানের অভিনয় :কবিগানে গানের প্রাধান্যের সাথে সাথে অভিনয়ের ব্যবহার যায়। শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নাটকের ভঙ্গিতে কবিয়ালের অভিনয় করে থাকেন ,ঢোলের তালে তালে অনেক কবিয়ালকে নাচতেও দেখা যায়। কবিয়াল দেবেন চৌধুরী ,সনৎ বিশ্বাস এরা বোলের তালে তালে আসর মাতাতেন ,নাটকের মতো ইম্প্রোভাইজেশন থাকে কবিগানে।গায়ে চাদর পাকিয়ে কোমর বেঁধে কখনো রুদ্রমূর্তি ধরেন ,কখনো ওই চাদর মাথায় দিয়ে মাতৃমূর্তি ধারণ করেন। এইভাবে গান ও সুন্দর অভিনয়ের কাঁধে ভর রেখে কবিগান তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে। 

Thursday, 19 October 2017

কবিগান এবং তার রীতিনীতি

কবির গানই কবিগান ,বিষয়টি দুজন কবিকে ঘিরে তৈরী হয়। একজন কবি নির্দিষ্ট বিষয়ের পক্ষ নিয়ে একটি গান করবে। তিনি নিজের যুক্তিতে ঐ বিষয়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করবে ,দ্বিতীয় কবি বিরুদ্ধ যুক্তি খাড়া করে প্রথম বিষয়কে হেয় প্রতিপন্ন করবে এবং নিজের বিষয়কে শ্রেষ্ঠ প্রমান করবে। এইরূপ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে কবিগান চলতে থাকে। যারা কবিগান করে তাদের কবিয়াল বলে আবার অনেকে 'ছড়াদার' বলে থাকেন,আবার কবিয়ালদের মধ্যে পাল্লাপাল্লি হয় বলে এঁদের পাল্লাদার বলেও অভিহিত করা হয়। শুধুমাত্র  গান দিয়ে কবিগান পরিবেশিত হয় না মাঝে মাঝে ছড়া  বা গদ্যের ব্যাবহারও সেখানে থাকে। কবিগান কবিরলড়াই নামেও খ্যাত। এ লড়াই কাব্য ও গীতির লড়াই বলা হয়ে থাকে। কবিয়াল আফাজুদ্দিন একটি ছড়ায় সুন্দরভাবে কবিগানকে ব্যাখ্যা করেছে।

                                                   " এ লড়াইয়ে নেই লাঠালাঠি ,
                                                            শুধু কথার কাটাকাটি ,
                                                              হয় না তাতে চটাচটি,
                                                     থাকে শুধু যুক্তির পরিপাঠি।"

কবিগানের রীতিনীতি : কবিগানের মূলগান শুরু হবার আগে দোহারিকা গানের মাধ্যমে দেবস্তূতি করে কবিগানের প্রস্তূতি আনেন। একে বলা হয় 'মহড়া',দোহারকিরা গলা ছেড়ে উচ্চ স্বরে খঞ্জনি বাজিয়ে এবং ঢোলকের জোর শব্দ বাজনার সাথে গান ধরেন। এছাড়া কবিয়ালের ছড়ার মাধ্যমে 'মা' এর বন্দনা করার পর পাঁচালি অর্থাৎ গানের মাধ্যমে মাতৃস্তূতি করতে থাকে। এরপর নানা বিষয়ের মধ্যে কবিয়ালদের তর্ক যুদ্ধ চলে ,কবিগানে কেনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়াকে 'উতোর' বলে এবং প্রশ্ন করাকে 'চাপান' বলে। কবিগানের কোনো সময়সীমা নেই সারাদিন ব্যাপী এই গান চলে পারে। কবিগানের শেষপর্বকে 'বোলকাটাকাটি' বলে আধুনিক কবিয়ালরা এই পর্বকে 'মিলনগীতি ' বলে থাকেন। যে বিষয় নিয়ে কবির লড়াই হয় সে বিষয় ছেড়ে ভিন্ন বিষয় নিয়ে বোলকাটাকাটি হয়। এই পর্বে প্রশ্ন ও উত্তরগুলো তুলনামূলক ছোট ,কবিগানের এই পর্ব খুব জমজমাট।
                                                          

Saturday, 7 October 2017

ভূমিকা

ব্রিটিশশক্তি যখন ভারতের তথা বাংলার  মাটিত  নিজেদের আঁখের গোছাচ্ছিল এবং দেশীয় রাজাদের একের পর এক পরাজিত করছিলো, এইরূপ প্রেক্ষাপট ঘিরে বাংলায়  কিছু  ইংরেজ তোষামোদকারী নব্য বাবু  শ্রেণী গজিয়ে উঠেছিল। তারা ইংরেজ কৃপাধন্য অর্থের সাহায্যে মদমত্ত ও বিলাসবহুল জীবন কাটাতে লাগলো প্রতি সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত এদের কোঠাবাড়িতে জলসার আসর বসত ,সেখানে খেউড় গান গাওয়া হতো। এই খেউড় থেকেই সেকেলের কবিগানের উৎপত্তি। ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ পর্যন্ত এই গানের বাজারদর ছিল আকাশছোয়া। এইসময় কবিগানের দিক্পালদের জন্ম হয়। ইশ্বরগুপ্তের কলমে 'কবিজীবনী',প্রফুল্ল পালের 'প্রাচীন কবিয়ালদের গান ',নিরঞ্জন চক্রবর্তীর ভাষায় 'ঊনবিংশ শতাব্দীর কবিয়াল ও বাংলা সাহিত্য ',এছাড়াও দীনেশচন্দ্র সেন ,সুশীলকুমার দে ,সুকুমার সেন ,অসিতকুমার বন্ধোপাধ্যায় প্রমুখ মহারথীগণ বাংলা সাহিত্যে কবিগানের বীজ বপন করেছে। এরপর কবিগানের সাম্রাজ্যে খরা নেমে আসে যার একটি অন্যতম কারণ ছিল উন্নবিংশ শতকের ইংরেজি শিক্ষায় জোয়ার। সেই জোয়ার ভাঁটা ফেলে দেয়  দেশীয় শিপ্লসংস্কৃতিকে। কলিকাতায় গজিয়ে উঠতে থাকে নতুন কায়দায় বিদেশী মডেলের থিয়েটার ফলে কবিগান শহরতলি থেকে সরে পথ খুঁজে নেয় মফস্বলের অলিগলিতে। কুঁড়ির দশকের গোঁড়া থেকে কবিগান আবার মাথা চারা দিতে থাকে। এইসময়ের দেশাত্মবোধক গানগুলো কবিগানের নবজাগরণের পথকে আরো দৃঢ় করে।কিন্তু  সেই ইতিহাস পুরোপুরি জানা যায়নি। ইতস্তত বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু কবিয়াল নিয়ে আলোচনা হলেও সামগ্রিক ইতিহাস আমাদের কাছে অজানা। কবিগানের  ঊষালগ্নে \মূলত কলকাতা ,হুগলী জেলাতে  প্রাধান্য ছিল। ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে হুগলী ,কলকাতা থেকে কবিগান পাততাড়ি গুটিয়ে চলে  আসে বর্ধমান ,বীরভূম ,নদীয়া ,মুর্শিদাবাদ এই জেলাগুলিতে । এই চারটি জেলাকে মধ্যবঙ্গ নামে খ্যাত ছিল। এই জেলাগুলিতে বিংশ শতাব্দীর অনেক কবিগানের  ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে তা বলা বাহুল্য।


                          সেকেলের বাবু কালচারে কবিগানের আসর  ( উৎস গুগল.কম )