- বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষ দিকে কবিগানের উদ্ভব হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞগন অনুমান করে থাকেন। কবি ঈশ্বরগুপ্ত গোঁজলা গুঁই কবিগানের আদি কবি বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য পন্ডিতগন এ বিষয়ে এক মত হতে পারেন নি। যাই হোক, কবিহানের পর্যালোনার জন্যে কবি ঈশ্বরগুপ্তই প্রধান পথ প্রদর্শন। কবিগান বাংলা সংস্কৃতির একটি বলিষ্ঠ ধারা। আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলা সংস্কৃতির এই বলিষ্ঠ সজীব ধারা নানা পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। কবিগান লোক সাহিত্যের অমুল্য সম্পদ হিসেবে গন্য হয়ে থাকে, কবিগান বাংলা সাহিত্যে যে ঐতিহাসিক ভুমিকা পালন করেছিল তা অনস্বীকার্য।
- জনগনের সাহিত্য হয়ে ওঠার সুচনা দেখা গেল কবিগানেই। মধ্য যুগীয় ব্যক্তি সন্তুষ্টির পথ পরিহার করে জনগনের মনের খোরাক যোগান দেওয়ার এই দায়িত্ব পালন করে কবিগানই। আধুনিক সাহিত্যের কাছে সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা তা সর্বপ্রথম কবিগানের মধ্যে দিয়েই পরিলক্ষিত হয়। আমরা জানি কাব্য সাহিত্য সমাজের দর্পণ।শতকরা আশি শতাংশ মানুষ যেখানে পল্লীতে বাস করে তার অর্ধেকের বেশী স্থান যেখানে এখনও দুর্গম। অনাহারে থেকে আমের আঠি,। বাঁশের কোঁড়, লাল পিঁপড়ের ডিম ক্ষিদের জ্বালায় উদরস্থ করে।যে দেশে সারা পৃথিবীর নিরক্ষর মানুষের অর্ধেক সংখ্যক মানুষ বাস।সেই সব অন্ত্যজ মানুষ সংগঠিত করাই কবিগানের উদ্দেশ্য। সাধনতত্ত্ব ব্যক্ত করতে গিয়ে কবিগান সে যুগের সমাজব্যাবস্থা, অর্থনীতি, শ্রেণী বৈষম্য, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, সামাজিক অরাজকতা প্রভৃতির পরিচয় দিয়েছেন। মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে সর্বত্র কম বেশী সামাজিক চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। বংলা ভাষায় অনুমোদিত মহাকাব্য রামায়ন-মহাভারত এছাড়া চন্ডীমঙ্গল, ধর্ম মঙ্গল, এই সমস্ত কাব্যে তৎকালীন সমাজ জীবনের নানা চিত্র চিত্রায়িত হয়েছে। কবিগানে বর্নিত সমাজে এই বাংলার। কবিগানে বর্নিত লোকাচার, সাধন-পদ্ধতি লোকায়ত মানুষের শিল্প সংস্কৃতি, সমাজ, প্রকৃতি সকলই বাংলার, সম-সাময়িক সমাজ প্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপুর্ন। বস্তুত সাহিত্যের মহৎ উদ্দেশ্য শুধু কল্পনা বিলাসী হয়ে অবাস্তব রুপ মাধুর্য ভোগ নয়। সাহিত্য শুধু বাস্তবকে এড়িয়ে কল্পনা বিলাস নয়। সততা রক্ষা অর্থাৎ সত্যভাষন সৎ সাহিত্যের প্রান ।
- পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ব্যাবস্থায় কবিগান- এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক যে কোলকাতা কেন্দ্রিক কবিগানে সমাজচিত্র তেমন ভাবে ফুটে ওঠেনি। এমন কি কলকাতাতে গড়ে উঠেছে যে শাসক শ্রেণী তাদের শাসন-শোষন, পীড়ন দমন তথা ঐতিহাসিক -রাজনৈতিক -সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত এদের গানে আসেনি। যদি কিছু কখনে এসে থাকে তা অকিঞ্চিৎকর। এই কবিদের উদ্দেশ্যই ছিল কবি গাহনায় রাজা-জমিদার দের চিত্তবিনোদন। তাই অধিকাংশ সময়ই কবিগান পরিবেশিত হতো রাধা-কৃষ্ণের চটুল প্রেম ও লীলা সংক্রান্ত, যার প্রধান উপাদান ছিল আদিরস এবং রাজা জমিদারদের চাটুকারিতা। তাই বলা যেতে পারে পুর্ববঙ্গে কবিগানের মাধ্যমে যে সমাজের এই সংস্কারমুলক ধারা এসেছিল, তা পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেনি।এটি মুলত চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেব ব্যবহৃত হয়।
![]() |
| কবিয়াল পালা গান করছেন উৎস -www.news24.com |

No comments:
Post a Comment