উনবিংশ শতাব্দীতে কোলকাতা কেন্দ্র করে রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে নবজাগরন ঘটে। এই নবজাগরন ব্রাহ্ম ধর্মান্দোলন ও নিউ হিন্দু মুভমেন্টের যে একটি বিশেষ ভুমিকা ছিল তা অনস্বীকার্য। রামমোহন প্রবর্তিত নবজাগরন ছিল শহরকে ঘিরে এবং সমাজের উঁচু শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ। গ্রামে সেই জোয়ার এসে পৌঁছাতে পারেনি। গ্রামের অন্ত্যজ, অবহেলিত মানুষের জীবনে এই শহরকেন্দ্রিক রেনেসাঁস কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি,তারা যে সংকীর্ণতায় ছিল সেই গন্ডিতেই রয়ে গিয়েছিল। এই ঊনবিংশ শতাব্দীতে পুর্ববঙ্গে অন্ত্যজ সমাজের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুর। তাঁদের প্রচেষ্টায় মতুয়া ধর্মান্দোলনের মাধ্যমে পুর্ববঙ্গের তথা বঙ্গদেশ অন্ত্যজ মানুষের নবজাগরন সৃষ্টি হয়। এই নবজাগরন ছিল সর্বব্যাপী। কলকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরনের মতো এই জাগরনের কোন সীমাবদ্ধতা ছিল না। মতুয়া আন্দোলনের মাধ্যমে অন্ত্যজ মানুষের মধ্যে শিক্ষা প্রসার, সমাজ সংস্কার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চাকরীর আন্দোলন প্রভৃতি সংঘটিত হয়।
রামমোহন প্রবর্তিত কলকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরনে মাইকেল মধুসূদন, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় প্রমুখ কবি সাহিত্যিক, দার্শনিক যে ভুমিকা পালন করেছিলেন হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত অন্ত্যজ মানুষের জাগরনে সেই একই ভুমিকা পালন করেছিলেন লোককবি ও অন্যান্য কবিবর্গ। কবি রসরাজ তারকচন্দ্র সরকার, হরিহর সরকার, রাজেন্দ্রনাথ সরকার, আচার্য মহানন্দ হালদার,বিচরন পাগল, কবি বিজয় সরকার, প্রমুখ মতুয়া রেনেসাঁসের কবি।ইউরোপের নবজাগরনে পেত্রার্ক, বোকাচিও,বেকন প্রভৃতির অবদান অনস্বীকার্য। মতুয়া নবজাগরনের লোককবিদের অবদান অপরিসীম। এই কবিরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লোকগানের আসরে গান করতেন এবং শ্রোতাদের নতুন আদর্শে দীক্ষিত করতেন। শিক্ষা বিস্তার এবং বিদ্যালয় গঠনে বিশেষ সহযোগিতা করেছেন।এমনও উদাহারন আছে কবিরা গানের আসরেই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি এবং অর্থ সংগ্রহ করেছেন এবং পরের দিনই সকলকে নিয়ে বিদ্যালয় গৃহ নির্মাণ করেছেন এই জাগরনে লোককবিদের অবদানের কথা কবি রাজেন্দ্রচন্দ্র সরকার একটি গানে বলেছেন -"কবিগানের জন্য জাগে ধন্য নমঃশূদ্র সমাজ। " এইভাবে বিভিন্ন সমাজ সংস্কারমূলক গানের মাধ্যমে কবিয়ালরে গামীন অন্ত্যজ সমাজে যে এক পরিবর্তনের ধারা এনে দিয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য।
No comments:
Post a Comment