Friday, 10 November 2017

কবিগানের ইতিহাস

 কবিগান বাঙালির হৃদয়ের সামগ্রী। জনসাধারণের মনোরঞ্জন ও লোকশিক্ষা এগানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। বাংলা লোকায়ত সাহিত্যের এক বিপুল সম্পদ কবিগানের খনিতে রয়েছে। কবিগানের উৎস ও উৎপত্তিকাল নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে।
কবিগানের আদি বীজ কবির কাব্যশক্তি পরীক্ষার মধ্যে থাকলেও আমরা যে কবিগানের প্রচলন দেখি তার সূচনা পর্বের ভূমি হলো শান্তিপুরের  কবিগান। গঙ্গাচরণ বেদান্ত বিদ্যাসাগর ভট্ট্যাচার্য মহাসয় আঁখড়াকেই সংগীত সংগ্রমের কবিগানের আদিরূপ বলে ব্যাখ্যা করেন -"শান্তিপুর ও ফুলিয়া গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় সংগীত সংগ্রামের অভিনয় উৎসাহের সহিত আরাম্ভ হয়ে গেলো "--এইরূপ বহুকাল ধরিয়া কৃষ্ণলীলার অপূর্ব মাধুর্য আস্বাদনের জন্য আঁখরাই পাড়ার সংগীত সংগ্রামে চলতে লাগলো। কালস্রোতে কবিগানের মাধুর্য ,রীতি বিকৃত হতে লাগলো। অর্থের প্রলোভনে কিছু কবিয়ালেরা  ভাষার নিয়ম ও ভাবসম্পদ উলঙ্গন করতে থাকে এবং কবিগান ব্যবসায়িক  স্বার্থে ব্যবহার হতে থাকে। সংগীত সংগ্রাম নাম পালটে হয়ে যায় কবির লড়াই বা তরজার লড়াই।
দেশ কালের সহিত সামঞ্জস্য রেখে কবিগান শান্তিপুর থেকে নতুন বাণিজ্য কেন্দ্র হুগলি -চুঁচুড়ার পথ ধরে কলকাতা নগরে পৌঁছায়। ইংরেজ অনুগ্রহে পুষ্ট ,নববীয়ানার বার্থ অনুকরণ প্রয়াসী যে জনসমাজ তখন সমগ্র দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ,তাদের মধ্যে দিয়ে কবিগানের প্রসার ঘটেছিলো। "মহারাজ বাহাদুর "নবকৃস্নাদেব এই শ্রেণীর অন্যতম আগ্র-প্রথিক। আচার্য দীনেশচন্দ্রে সেন মনে করেন যাত্রা থেকে কবিগানের উৎপত্তি হয়েছে। তার মোতে উড়বে কবিগান যাত্রার অংশ ছিল ,তারপর এই হালকা ধরণের গান যাত্রা থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে 'কবিগান 'নামে পরিচিতি লাভ করে এবং লোকরঞ্জনের একটি বিশেষ রূপ ধারণ করে। ডঃ সুশীলকুমার দে এর প্রতিবাদ করেন। তিনি তিনটি বিরোধী কারণ প্রতিস্থাপিত করেন। প্রথম কারণ ,কবিগান যে যাত্রার অংশ ছিল ,এ ধরণের প্রমান দেবার মতো কোনও নতুন পাওয়া যায়নি। .দ্বিতীয়ত ,কবিগান ও যাত্রার ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা। তৃতীয়ত ,একই সময়ে যখন কবিগান ও যাত্রার অস্তত্ব পাওয়া যাচ্ছে ,তখন এক থেকে অপরের উৎপত্তি হয়েছে ,একথা বলা যুক্তিযুক্ত নয়। ডঃ হরেকৃষ্না মুখোপাধ্যায় মনে করেন পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত ঝুমুর থেকেই কবিগানের উৎপত্তি হয়েছে। সংলাপধর্মী বা প্রশ্নোত্তরমূলক রচনা ,যাতে নৃত্যগীতের প্রচুর ব্যবহার ছিল ,মধ্যযুগে তাকে বলা হতো ঝুমুর। আদিরস ঘটিত ঝুমুর কালক্রমে পরিবর্তিত হতে হতে কবিগান নামে পৃথক আরেকটি লোকনাট্যের রূপ দেয়। ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র পাল মহাশয় মনে করেন ,সপ্তদশ শতাব্দীতে কবিগানের কোনরূপ অস্তিত্ব ছিলনা। এ মন্তব্য কোনোমতেই শরিকের করা যায়না। কবিগানের মতভেদ নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বেও যে কবিগানের চল ছিল তাতে সন্দেহ নেই। ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ খিষ্টাব্দের মধ্যে ঘটেছিলো বলে ডঃ দে অভিমত দিয়েছেন। অধ্যাপক দে কবিগানের যে তিনটি পর্যায় করেছেন তাতেও দেখা যায় প্রথম পর্যায় ১৭৬০ এর পুর্ববর্তী কালকে চিন্তিত করেন। সুকুমার সেনের মতো সুশীলকুমার দে কবিগানের কোনো প্রাচীনতম নিদর্শনের উল্লেখ করেননি এবং এই প্রসঙ্গে জানিয়েছে যে ,উপযুক্ত তথ্যাদির অভাবে প্রাচীনতম কবি সংগীতের প্রসঙ্গে কিছু বলা সম্ভব না।
'It is very difficult in the absence of materials to trace the origin of this peculiar from of literature ...most of the songs which have come down us belong to a date posterior to middle of the 18th century.

কবিগানের পর্ব  -
প্রথম পর্ব ;-অষ্টাদশ শতাব্দীর পুর্ববর্তী যুগ। এসময়ের কবিগান ও কবিয়াল সম্পর্কে  কিছুই জানা ছিল না.অনুমান করা হয় এযুগেও কবিগানের অস্তিত্ব ছিল।
দ্বিতীয় পর্ব ;অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকে মধ্য ভাগ পর্য্যন্ত। গোঁজলা গুই এবং তার তিন শীষের পরিচয় পাওয়া যায়। এদের জীবন সংকান্ত কিছু তথ্য ও কয়েকটি গান পাওয়া গেছে।
তৃতীয় পর্ব ;অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে থেকে ঊনবিশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক। হৰু ঠাকুর ,নিতাই বৈরাগী ও রাম  বসুর এসময়ে শ্রেষ্ঠ কবিয়াল।
চতুর্থ পর্ব :ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। এযুগে বেশ কয়েকজন শক্তিশালী কবিয়াল জন্মেছিলেন। এঁদের মধ্যে ভোলা ময়রা ,এন্টিনি ফিরিঙ্গি অন্যতম ছিলেন।


Thursday, 2 November 2017

কবিগানের রণকৌশল

কবিগানের সাঁজ ও পোশাক : কবিগানকে আরো অলংকৃত করার জন্য কবিয়ালের ধুতি পান্জাবি পড়েন। সাদা ধুতি হলেও পাঞ্জাবি সাদা বা ঘি রঙের পড়তে দেখা যায়। সাদা বা ঘি রঙের উত্তরীয় এর পাতলা  দিকটা তিন ভাঁজ বা চার ভাঁজ করে মেলে দেন অথবা একদিকে বগলের নিচ দিয়া অপর  কাঁধের উপর দিয়া ছড়িয়ে দাও হয়। মঞ্চে কবিয়ালরা খালি পায়ে থাকেন। তবে এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার কবিদের মধ্যে পোশাকের সামান্য তারতম্য আছে ,ধুতি ও পাঞ্জাবির ব্যাপারে এক হলেও ওপর বাংলার কবিয়ালেরা গলায় মাফলার জড়ান ,পায়ে মোজা  পড়েন। মহিলা কবিয়ালের লাল ও সাদা পাড়ের সাদা সুতির কাপড় পড়েন। অনেক সময় কাপড়ের গায়ে ছোট বুটি  থাকে,উত্তরীয় ব্যবহার করতে দেখা যায়। যাঁরা ঢোল বজায় তাঁরা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া পড়েন ,ইদানিং অনেক ঢোলবাদক পাজামা ব্যবহার করছে।

কবিগানের বাদ্যযন্ত্র : একসময়ে কবিগানে বাদ্যযন্ত্র : একসময় কবিগানে বাদ্যযন্ত্র বলতে শুধু ঢোল ,জুড়ি ও কাঁসির ব্যবহার দেখা যেত। ঢোলের সাথে কাঁসির ব্যবহার হতো। এখন কাঁসির ব্যবহার আর নেই। ইদানিং কিছু বাদ্যযন্ত্রের আবির্ভাব হয়েছে। সুরের সাথে আঁড়বাঁশির ব্যাবহারও দেখা যাচ্ছে এবং হারমোনিয়ামের ব্যবহার এখন আবশ্যক হয়ে পড়েছে। বাদ্যযন্তের প্রাচীন ধারা অব্যাহত রেখেই কবিয়ালরা এখনো কবিগান করে চলেছে বিষয়টা সত্যি প্রশংসনীয়।

কবিগানের অভিনয় :কবিগানে গানের প্রাধান্যের সাথে সাথে অভিনয়ের ব্যবহার যায়। শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নাটকের ভঙ্গিতে কবিয়ালের অভিনয় করে থাকেন ,ঢোলের তালে তালে অনেক কবিয়ালকে নাচতেও দেখা যায়। কবিয়াল দেবেন চৌধুরী ,সনৎ বিশ্বাস এরা বোলের তালে তালে আসর মাতাতেন ,নাটকের মতো ইম্প্রোভাইজেশন থাকে কবিগানে।গায়ে চাদর পাকিয়ে কোমর বেঁধে কখনো রুদ্রমূর্তি ধরেন ,কখনো ওই চাদর মাথায় দিয়ে মাতৃমূর্তি ধারণ করেন। এইভাবে গান ও সুন্দর অভিনয়ের কাঁধে ভর রেখে কবিগান তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে।